top of page

একদিনে প্যারিস - পর্ব ৬

  • Writer: Achyut
    Achyut
  • Oct 7, 2023
  • 5 min read

'একদিনের প্যারিস' এর ষষ্ঠ পর্বে শুধুই আইফেল টাওয়ার - প্যারিসের সমার্থক শব্দ এবং পৃথিবীর বিস্ময়


যে দিক থেকে এসে ল্যুভরে ঢুকেছিলাম সেই Quai Francois Mitterrand রাস্তা ধরে এবার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করলাম। সেইন নদীকে বাঁ দিকে রেখে রাস্তা চলেছে, কখনও তার নাম Quai des Tuileries Cours, কখনও বা La Reine আর একদম শেষে Av. De New York। এই রাস্তায় গাড়ি চলে না, এটা শুধু মাত্র পায়ে হাঁটা পথিকের জন্য, গাড়ির রাস্তা আমার ডানদিকে। জানি নদী পেরোতে হবে, পেরিয়ে এসেছি ৮ টা মতো ব্রিজ, কিন্তু এখনও নদী পেরোইনি। কারণ আমি চলেছি আইফেল টাওয়ার দেখতে, আর সেটা আমি আগে দেখবো নদীর এপার থেকে। বৃষ্টিটা থেমেছে, সাদা মেঘগুলো খুব লড়াই করছে আকাশে নিজেদের হারানো জায়গা ফিরে পেতে। কালো মেঘের দল পিছু হটছে।


১৫ মিনিট কেটে গেছে, আমি হাঁটছি, খিদেটা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে, এমন সময় দূরে নদীর ওপারে চোখে পড়লো আইফেল টাওয়ারের কালো প্রতিকৃতিটা। বর্তমান পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য এই আইফেল টাওয়ার প্রথম চোখে দেখার বিবরণটা অনেক নাটকীয় ভাবে দিতে পারতাম, কিন্তু বস্তাপচা বিশেষণ ব্যবহার না করে ঠিক যেমনটা অনুভব করেছিলাম, সোজাসাপটা সেটাই লিখছি। নীল হতে শুরু করা আকাশের ব্যাক ড্রপে, আশেপাশের সমস্ত কিছুর থেকে মাথা উঁচিয়ে থাকা আইফেল টাওয়ারের সেই ল্যান্ডস্কেপ - সত্যি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জানি সময়ে পৌঁছতে হবে টাওয়ারের পাদদেশে, তবুও এই পরিবেশে পা আপনা হতেই থেমে যায়, ক্যামেরা বের করার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। কিছু ছবি তুলে আবার এগুলাম, দূর থেকে দেখা সার্থক হবার পর কাছে যাওয়ার আর তর সইছিল না। ল্যুভর থেকে আইফেল টাওয়ারের প্রথম দেখা পেতে এই ৪৫ মিনিটে হেঁটে এসেছি প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। অবশেষে Pont D’lena ব্রিজ পেরিয়ে মুখোমুখি হলাম আইফেল টাওয়ারের।


Eiffel Tower
First view of the Eiffel Tower

দ্রষ্টব্য সাত - Eiffel Tower


ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তাটা দু'ভাগে ভাগ হয়েছে। আমি জানতাম দুদিক দিয়ে ঢোকা যায়, কিন্তু পূর্ব দিকের রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকে। তাই ওই দিক দিয়েই ঢুকব ঠিক করে রেখেছিলাম আর সেই মতো বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগুলাম। কিছুদূর যাবার পর মোবাইলের ই-টিকিট সিক্যুরিটি গার্ড কে দেখিয়ে, নিজের শরীরের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে মানে টাওয়ারের নীচে, যেখানে চারদিক থেকে চারটে লোহার পা মাটির সাথে কোনাকুনি করে উঠে গেছে ওপরে। এই জায়গাটার নাম এসপ্ল্যানেড, এখানে প্রচুর লোকের ভিড়, তারা কেউ ছবি তুলছে, কেউ টিকিট কাটতে ব্যস্ত, অনেককে দেখলাম একসাথে বসে আড্ডাও মারতে – সত্যি আড্ডা মারার আদর্শ জায়গা বটে। প্রতিটা পায়ের নীচে টিকিট চেক করে ভেতরে যাবার লাইন, ভালো করে দেখে বুঝলাম যাদের আগে থেকে টিকিট কাটা তাদের জন্য আলাদা লাইন, সবুজ রঙে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। সেই মতো গিয়ে হাজির হলাম, তারা দেখে বলল, টিকিটে যে সময় দেওয়া আছে, তার ১৫ মিনিট আগে ঢোকা যাবে না। ঘড়িতে সময় হিসেব করে দেখলাম ১০ মিনিট কাটাতে হবে আরও।


An open space with a food stall and tourists
The esplanade area of the tower

এসপ্ল্যানেড চত্বরে প্রচুর খাবার দোকান, তার মধ্যে একটাতে গিয়ে স্যান্ডউইচ, কেক আর কফি দিয়ে লাঞ্চটা সেরে নিলাম। প্রচুর পায়রা জাতীয় পাখীর ভিড় সব জায়গাটা জুড়ে, তারা মানুষ কে ভয়ই করে না। অনেক ট্যুরিস্টকে দেখলাম তারা এক হাতে খাবার নিয়ে অন্য হাতে একটা পাখীকে বসিয়ে তাকে খাওয়াচ্ছে। আমার খাবার সময় তারা এত কাছে চলে আসছিল, যে দু একবার হুস হুস করে তাড়াতেও হল। খেতে খেতে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, ১৮৮৯ সালে এতো বড় ১০০০ ফুট লম্বা একটা জিনিস তৈরি হয়েছিল শুধু মাত্র লোককে দেখানোর জন্য যে ফ্রান্সের পয়সা আর কারিগরি দক্ষতা আছে পৃথিবীর সব থেকে উঁচু স্থাপত্য বানানোর। বইয়ে পড়েছি, ২০ বছর পর যখন এটাকে ভেঙ্গে ফেলার কথা বলা হয়, তখন এর স্থপতি Gustave Eiffel এর মাথায় রেডিও অ্যান্টেনা আর টেলিগ্রাফ ট্রান্সমিটার বসিয়ে দেন যেগুলো ব্যবহার হয়েছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান রেডিও কমিউনিকেশন আটকানোর কাজে। এই সব ভাবতে ভাবতে খাওয়াও শেষ আর যাবারও সময় হয়ে গেছে।


সবুজ রঙে নির্দেশ দেওয়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম মোবাইলে ই-টিকিট দেখিয়ে। ঢুকে দেখি আবার লাইন, এবার সিক্যুরিটি চেকের। একটা ছোট ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, যেখানে একদিকে শরীরের পরীক্ষা আর একদিকে সঙ্গের জিনিসপত্রের পরীক্ষা হচ্ছে। অনেকটা এয়ারপোর্টে যেরকম হয়, সে রকম। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে সামনে একটা ছোট বাড়ির মতো, যেখানে ঢুকে সোজা এগিয়ে গেলে বাঁদিকে একটা লিফট, প্রচুর লোক তার সামনে অপেক্ষা করছে। আমিও ভিড়ে গেলাম সেখানে, মিনিট দুই দাঁড়ানোর পর, লিফট এল যাতে একসাথে ৩০ জন মত লোক ঢুকতে পারে। আমাদের সবাইকে নিয়ে লিফট রওনা দিল ওপরে। কয়েক সেকেন্ড পরেই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে লিফট বাইরে বেরিয়ে আসতেই বুঝতে পারলাম ওপরে উঠছি আইফেল টাওয়ারের চারটে পায়ের একটা দিয়ে। নীচে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে প্যারিস শহর। প্যারিসিওরা ভালবেসে এই টাওয়ার কে ডাকে la dame de fer বলে, যার ইংরাজিতে মানে করলে দাঁড়ায় The Iron Lady।


A structure in the backdrop of sky
On the way to the top

এই লেডির শরীরে তিনটে উচ্চতায় ট্যুরিস্টদের দাঁড়ানোর জায়গা আছে – ইংরাজিতে যাদের বলে অবজারভেশন ডেক। কোমরের কাছে প্রথমটা – উচ্চতা ২০০ ফুট, পরেরটা পেটের কাছে - উচ্চতা ৪০০ ফুট, আর একদম ওপরেরটা গলার কাছে - ৯০০ ফুটে। যদিও কোন কোন লিফট এক তলায় দাঁড়ায়, আমাদেরটা প্রথমে দাঁড়াল ২ তলায়। আমার টিকিট কাটা ছিল একদম ওপর তলা অবধি যাওয়ার, তাই ওপর থেকেই শুরু করবো ঠিক করে রেখেছিলাম। ২ তলায় লিফট পালটে অন্য একটা লিফট ধরতে হল, সেখানেও লম্বা লাইন। আর সেই লাইনে কোন দেশী লোক নেই – ভারতীয় ও চোখে পরল বলে মনে হল। ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে, লিফট এল, আর সেই লিফট ধরে একদম ওপরে।


আকাশ পরিষ্কার এখন, রোদ উঠেছে ঝকঝকে, আর সেই আলোয় নীচে ভেজা প্যারিস শহর নিজেকে শুকিয়ে নিচ্ছে একটু একটু করে। এ যে কি অনুভূতি, তা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। গোল করে ঘেরা ডেকে প্রচুর ভিড়, কেউ সেলফি তুলতে ব্যস্ত, তো কেউ শহরের ছবি তুলতে। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়, চেনা পৃথিবীর পরিচিত জিনিস গুলো যেন সব কোন মন্ত্রবলে লিলিপুট হয়ে গেছে বলে মনে হয়। আশেপাশে ঘুরে বেড়ালাম আরও একটু, উঁকি মেরে দেখলাম Gustave Eiffel এর কেবিনে, যেখানে সাজানো ঘরে Eiffel আজও বসে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত Thomas Edison এর সাথে। এবার নীচে নামব, তবে লিফটে না, সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম দোতলায়।


Two figures chatting
Gustave Eiffel and Thomas Edison

আসার আগে পড়েছিলাম, দোতলার এই ডেক থেকে সব চেয়ে ভালো লাগে নীচে ছড়িয়ে থাকা প্যারিস শহরকে দেখতে। এখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম কথাটা কতদূর সত্যি। প্রথমত, এখানে লোকের ভিড় ওপরের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম, তাই দাঁড়ানো যায় ভালো ভাবে। দ্বিতীয়ত, অত ওপর থেকে নীচে দেখলে মাথা ঘোরে – এখানে সেই সমস্যাটাও কম। আর সব থেকে যেটা ভালো, শহরটাকে ওপর থেকে দেখাও হয় আর চিনতেও পারা যায় - আলাদা করা যায় বাড়ির উঁচু মাথা গুলো, আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা অনেক দ্রষ্টব্য স্থান। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে বাঁদিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি সেইন নদী, আর তার পেছনে Jardins du Trocadero বা Trocadero Gardens। ডানদিকে Champ de Mars পার্ক, যা টাওয়ারের নীচে থেকে শুরু হয়ে যতদূর চোখ যায়, ততদূর অবধি ছড়ান। পেছনে অস্তগামী বিকেলের সূর্যের অস্তিত্ব সামনে লম্বা হতে থাকা টাওয়ারের ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। প্রায় আধ ঘণ্টা মত কাটিয়ে, নীচে নামা শুরু করলাম, এবারো সিঁড়ি ভেঙ্গে। একতলায় কিছু খাবারের দোকান, সুভেনিরের দোকান দেখে নীচে নামার লিফট ধরলাম। ওঠার সময় ছোট হয়ে আসা শহর আবার ফিরে এলো তার পুরনো চেহারায়, আর আমিও বাইরে বেরিয়ে কিছু সুভেনির কিনে ফেরার পথ ধরলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আবার মেঘ করেছে আর সেই মেঘলোকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নীচের শহরের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছে প্যারিসের প্রিয় লৌহ মানবী।


An aerial view of the Paris city
View from the top

আইফেল টাওয়ার সম্পর্কে কয়েকটা আকর্ষণীয় তথ্য এখানে লিখে রাখার লোভ সামলাতে পারলাম নাঃ

  1. আইফেল টাওয়ার লোহার তৈরি, ইস্পাত দিয়ে নয়। এই লোহা এসেছিল পূর্ব ফ্রান্সের Pompey থেকে।

  2. মরচে বা ক্ষয় থেকে রক্ষা করার জন্য, এই লোহা রঙের একটা পুরু কোট দিয়ে আবৃত করা হয়, যা প্রতি সাত বছর অন্তর করতে হয়। এই রঙ করার সময়সূচী গুস্তাভ আইফেল নিজেই সুপারিশ করেছিলেন, যা এখনও মেনে চলা হয়।

  3. ১৮৮৯ সালে তৈরি হবার পর এই টাওয়ার ছিল প্রথম ১০০০ ফুট উঁচু টাওয়ার। ৪০ বছর ধরে আইফেল টাওয়ার পৃথিবীর সবথেকে উঁচু বিল্ডিং ছিল ১৯৩১ সালে নিউ ইয়র্কে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত।

  4. আইফেল টাওয়ার রেকর্ড সময়ে নির্মিত হয়েছিল: 2 বছর, 2 মাস এবং 5 দিন। জানুয়ারী 1887 এর শেষ থেকে 31 মার্চ, 1889 পর্যন্ত।

  5. প্রতি বছর ৬ মিলিয়ন মানুষ আইফেল টাওয়ার দেখতে আসেন। আইফেল টাওয়ার প্রতিদিন খোলা থাকে। সকাল ৯:৩০ টা থেকে রাত ১১:৪৫ পর্যন্ত। গরম কালে সকাল ৯:০০ টা থেকে রাত ১২:৪৫ টা পর্যন্ত।

  6. আইফেল টাওয়ারের ওজন প্রায় ১০,১০০ টন। লোহার কাঠামোর ওজন 7,300 টন। কাঠামো রক্ষার জন্য যে রঙ করা হয়, সেই রঙের ওজন মাত্র 60 টন।

Commentaires

Noté 0 étoile sur 5.
Pas encore de note

Ajouter une note
bottom of page