চীনের এক শতাব্দী প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় - পর্ব ৪
- Achyut
- Oct 25, 2023
- 5 min read
এই দেশে কাটানো জীবনের বেশীর ভাগ সময়টা যেহেতু একলা, তাই বাড়িতে রান্না করে খাওয়া খুব একটা হয়ে ওঠেনি। কখনও সেটা সময়ের অভাবে, কখনও বা ইচ্ছের অভাবে। তাই দুপুরের আর রাতের খাবার জন্য ইউনিভার্সিটির যে জায়গায় আমাকে দিনে দু'বার করে যেতেই হতো, সেটার নাম ক্যান্টিন। এই পর্বে থাকলো সেই ক্যান্টিনের গল্প -
১। খাবারের সময় - যেটার সাথে তাল মেলাতে আমার লেগেছিল বেশ কয়েকটা দিন
২। খাবারের সম্ভার - ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দশটা ক্যান্টিন
৩। খাবার নেওয়ার পদ্ধতি - হাতে হাতে টাকা দেওয়া নেওয়ার পদ্ধতি এখানে অচল
খাবারের সময়
ছোটবেলা থেকে বাড়িতে মা'কে বলতে শুনেছি, "দেখেছিস, এতো কাজ সেরে ঠিক সময়ে রান্না করে খেতে তো দিতে পারলাম।" ঠিক সময় বলতে, দুপুরে দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে, আর রাতে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। খাবারের এই সময়ে আমরা বড় হয়েছি। পরে কলকাতা হোক, কি হায়দ্রাবাদ, কিংবা মুম্বাই - সব কর্মক্ষেত্রে দেখেছি লাঞ্চের সময় দুপুর একটা থেকে দুটো। বিগত এই ত্রিশ বছরের অভ্যেস এখানে এসে পালটাতে হল। চাইনীজদের খাবারের সময় আমাদের থেকে অনেকটা আলাদা, যাকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায় - ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার।
ব্রেকফাস্ট
সময় - সকাল ৭টা থেকে ৯টা
এখানে স্কুলকলেজ শুরু হয় সকাল ৮টায়। তাই ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বা স্কুল কলেজের সাথে যুক্ত লোকেদের ব্রেকফাস্টের সময় সাধারণত ৭টার কাছাকাছি হয়। আর এখানে অফিস টাইম শুরু হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। তাই অফিসের লোকজনের ব্রেকফাস্টের সময় সাধারণত ৮টা।
ব্রেকফাস্ট এখানে খুব সময় নিয়ে খাওয়া হয় না। দোকান থেকে খাবার কিনে কর্মস্থলে যেতে যেতে এরা ব্রেকফাস্ট করে নেয়। ইউনিভার্সিটিতেও দেখেছি, ছেলেমেয়েরা ক্যান্টিন থেকে খাবার নিয়ে ক্লাসে যাবার রাস্তায় খেয়ে নেয়। ব্রেকফাস্ট এখানে সাধারণত সয় মিল্ক, পোরিজ, বান, বা রাইস নুডলস। গুয়াংজুতে ব্রেকফাস্টের সময়টা একটু লম্বা, বিশেষত শনি রবিবারে। এই দিনে লোকজন একটু ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে zaocha, ইংরেজি ভাষায় যার অর্থ morning tea। চায়ের সাথে থাকে এখানকার বিখ্যাত 'ডিম সাম'।
ডিম সামের ইংরেজি মানে 'touch the heart', মানে এমন একটা খাবার যেটা 'হৃদয় স্পর্শ করে'। ডিম সাম কোন একটা খাবার নয়, চায়ের সাথে পরিবেশন করা অনেক ছোটো ছোটো খাবারকে একসাথে বলে ডিম সাম। এই খাবার হতে পারে সেদ্ধ বা ভাজা বান, ডাম্পলিং বা মোমো, বিভিন্ন রকমের পূর দেওয়া রোল। দক্ষিণ চীন, মানে গুয়াংডং প্রদেশ এবং হং কং, থেকে উৎপন্ন হওয়া এই খাবার আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
লাঞ্চ
সময় - সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ২টো
এখানে দুপুরের খাবার খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়। লাঞ্চের পরে এখানকার লোকজন এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমোয়। তাই লাঞ্চ শেষ করার একটা তাড়া থাকে। খাবারের মেনু খুব সাধারণ - নুডলস বা ভাত, পাশাপাশি কিছু মাংস এবং শাকসব্জী, তিন রকম খাবারের বেশি নয়। তবে যদি কোনও বিশেষ উপলক্ষ থাকে, যেমন মিটিঙের পরে লাঞ্চ, তাহলে মেনুতে অনেক কিছু থাকে।
বেশির ভাগ মানুষ লাঞ্চ সাধারণত স্কুল বা অফিসের ক্যান্টিনে খায়, বা কোন রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে নেয়। আমাদের ক্যান্টিনে দেখেছি কিছু লোককে বাড়ি থেকে লাঞ্চ বক্স নিয়ে এসে তাতে করে খাবার নিয়ে যেতে। আবার কেউ কেউ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসে, ক্যান্টিনের মাইক্রোওয়েভে গরম করে সেখানে বসেই খেয়ে নেয়।
ডিনার
সময় - বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা
ডিনার এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা দিনের এমন একটা খাবার যেটা পরিবারের সবাই মিলে বসে একসাথে খেতে পারে। অনেক রকমের খাবার থাকে মেনুতে - স্যুপ, বিভিন্ন ধরণের মাংস, শাকসব্জী, ভাত। যে কোন রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যে ৭টার সময় হচ্ছে সবথেকে ব্যস্ত সময়। এই সময় যখনই কোন রেস্টুরেন্টে গেছি, দেখেছি লোকজন হয় বেশ কিছু বন্ধুর সাথে অথবা পরিবারের অনেক লোকজনের সাথে বসে খাচ্ছে। অনেক সংখ্যক লোক যাতে একে অপরের মুখোমুখি বসে খেতে খেতে গল্প করতে পারে, তাই প্রায় সমস্ত ফ্যামিলি রেস্টুরেন্টের টেবিলগুলো গোল হয়। আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, যতজন মানুষ একসাথে খেতে যায়, সবাই একটা করে মেনু অর্ডার করবেই। সেটা তারপর সবাই মিলে খাওয়া হয়। প্রথম প্রথম অবাক লাগলেও পরে জানতে পেরেছি, এই ভাবে খাবার অর্ডার দেওয়া হয় যাতে খাবার টেবিলে সবার মতামত সমান গুরুত্ব পায় আর সবাই সবার পছন্দমতো খাবার নিতে পারে।
এখানকার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের সময়ের সাথে নিজের ঘড়ি মিলিয়ে নিতে নিতে একদিন অভ্যেসটা দাঁড়ালো এরকম -
সকালে বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে অফিস যাওয়া। দুপুর সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ক্যান্টিনে গিয়ে লাঞ্চ বক্সে করে খাবার নিয়ে অফিসে আসা, দুপুর সাড়ে ১২টার সময় লাঞ্চ করা। বিকেলে সাড়ে ৫টার সময় আবার একটা বক্সে করে ডিনার নিয়ে বাড়ি ফেরা। রাত ৯টার সময় সেই খাবার মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নেওয়া। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের সময়টা এখানকার কাছাকাছি আনতে পারলেও, ডিনার সেই দূরেই রয়ে গেছে। তাই আজও অফিসের লোকজনের সাথে ডিনারে গেলে সন্ধ্যে ৬টা সাড়ে ৬টার সময় ভালো করে খেতে পারিনা, শুধু অল্প কিছু খাবার আর সবার সঙ্গ উপভোগ করে চলে আসতে হয়।
ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন
সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির মেন ক্যাম্পাস, মানে South ক্যাম্পাসে মোট দশটা ক্যান্টিন আছে। ক্লাসরুম, হোস্টেল, অফিস - সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই দশটা ক্যান্টিন ছড়িয়ে আছে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন জায়গায়।
পাঁচ তলা ক্যান্টিন - সবথেকে বড় এবং সবথেকে নতুন
এই ক্যান্টিনের নাম Songtaoyuan।
হোস্টেলের কাছে
ক্যান্টিন এবং রেস্টুরেন্ট দুটোই আছে এর মধ্যে
৫৮০০ জন একসাথে বসে খেতে পারে এক সময়ে
ক্যান্টিনের সময়ঃ সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা (ব্রেকফাস্ট), ১১টা থেকে ১টা ২০ (লাঞ্চ), বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা (ডিনার)
রেস্টুরেন্টের সময়ঃ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টো (লাঞ্চ), বিকেল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা (ডিনার)

ওয়েস্টার্ন খাবারের ক্যান্টিন - South Lawn ক্যান্টিন
ক্লাসরুম চত্বরে
৬১৬ জন একসাথে বসে খেতে পারে এক সময়ে তিনতলা এই ক্যান্টিনে
একমাত্র ক্যান্টিন যেখানে চাইনীজ এবং ওয়েস্টার্ন - দুরকম খাবার পাওয়া যায়
ক্যান্টিনের সময়ঃ সকাল ১০টা ৪৫ থেকে দুপুর ১টা (লাঞ্চ), বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা (ডিনার)
Xueyi ক্যান্টিন - যেখানে আমি খেতে যাই
ক্লাসরুম এবং অফিস চত্বরে
৬৪৪ জন একসাথে বসে খেতে পারে দোতলা এই ক্যান্টিনে
ক্যান্টিনের সময়ঃ সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ১০টা (ব্রেকফাস্ট), সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা ৩০ (লাঞ্চ), বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা (ডিনার), সন্ধ্যে ৭টা থেকে রাত ১০টা (সাপার)
Xue5 ক্যান্টিন - ইউনিভার্সিটির East গেটের কাছে
হোস্টেল চত্বরে
একতলায় চাইনীজ খাবার, আর দোতলায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাবার পাওয়া যায়
ক্যান্টিনের সময়ঃ একতলা - সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা (ব্রেকফাস্ট), ১১টা থেকে দুপুর ১টা ২০ (লাঞ্চ), বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা (ডিনার); দোতলা - সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা ৩০ (লাঞ্চ), বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা (ডিনার)
এখানে আমি চারটে ক্যান্টিনের কথা লিখলাম। এছাড়াও আছে
Chunhuiyuan ক্যান্টিন (১৬০০ জন একসাথে বসতে পারে)
May ক্যান্টিন
Northwest ক্যান্টিন (এখানে মুসলিম খাবার পাওয়া যায়)
Kangyuan ক্যান্টিন
Puyuan ক্যান্টিন
Zhongda Kaifeng হোটেল (তিন রকমের রেস্টুরেন্ট আছে এই হোটেলে - চাইনীজ, ওয়েস্টার্ন, আর শুধু মাছের বিভিন্ন পদের একটা রেস্টুরেন্ট), আর
Bauhinia Garden রেস্টুরেন্ট (প্রধানত Cantonese খাবার, এছাড়াও আছে Hunan এবং Sichuan প্রদেশের খাবার)
খাবার নেওয়ার পদ্ধতি
এখানে ক্যান্টিনে খাবার নেওয়ার পদ্ধতি একটু আলাদা।
প্রত্যেক ক্যান্টিনে অনেকগুলো কাউন্টার আছে। এক একটা কাউন্টারে এক এক রকম খাবার পাওয়া যায়। কাউন্টারের সংখ্যা ক্যান্টিন হিসেবে আলাদা আলাদা হয়। আমি যে ক্যান্টিনে যাই, সেখানে যেরকম কাউন্টারের সংখ্যা ১২।
এক একটা কাউন্টারে খাবারের মেনু ৩-৪টে। এমনকি ভাতের কাউন্টারে দু'তিন রকমের চালের ভাত থাকে।
প্রত্যেক কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকেন উর্দি পরা একজন করে পুরুষ বা মহিলা। উর্দির রং সাদা, হাতে নীল গ্লাভস, মাথায় সাদা-নীল টুপি। সেই কাউন্টারে রাখা খাবার দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর হাতে।
সব কাউন্টারে একটা কাঁচের পার্টিশন আছে। এই পার্টিশনের নীচের দিকটা ফাঁকা। যেখান দিয়ে খাবার কাউন্টারের ওদিক থেকে এদিকে আসতে পারে।
এই কাঁচের পার্টিশনের গায়ে দুটো করে মেশিন লাগানো - খাবারের দাম দেওয়া নেওয়া করার জন্য। দু'রকম পদ্ধতিতে হয় এই ব্যাপারটা। একটা হল ইউনিভার্সিটির আইডেন্টিটি কার্ড দিয়ে। এই কার্ড রিচার্জ করানো যায়। খাবার নেওয়ার পর কাউন্টারের ওদিক থেকে সেই খাবারের দাম এই মেশিনে টাইপ করে দেওয়া হয়। মেশিনের এদিকে কার্ড টাচ করালে কার্ড থেকে সেই দাম কেটে যায়।
আর একটা উপায় হল ইউনিভার্সিটির নিজস্ব অ্যাপ দিয়ে পেমেন্ট করা। এই অ্যাপ খুললে একটা QR কোড আসে। মেশিনের ওদিকে খাবারের দাম টাইপ করার পর এদিক থেকে মেশিনে সেই QR কোড স্ক্যান করলে টাকা কেটে যায়।
প্রথম এবং প্রধান কাউন্টার ভাতের। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে ক'হাতা ভাত নিতে চাইছি, সেটা বলতে হয়। এক হাতা ভাতের দাম ০.৩ RMB, মানে ভারতীয় টাকায় ৩০ পয়সা মতো। এই কাউন্টার থেকে ভাত দেওয়া হয় একটা থালায়, যেটাতে ভাতের জায়গা ছাড়াও আরও তিনটে খোপ থাকে। ছোটবেলায় বাড়িতে এরকম থালা দেখেছি। এই ভাত নিয়ে এবার যেতে হয় নিজের পছন্দমতো খাবার যে কাউন্টারে আছে সেখানে। নিজের পছন্দ মতো খাবার নিয়ে পেমেন্ট করে দিলেই কাজ শেষ। কয়েকটা ক্যান্টিনে এই প্রত্যেক কাউন্টারে পেমেন্টের ব্যাপারটা নেই। সব খাবার নেওয়া হয়ে গেলে এক জায়গায় গিয়ে পেমেন্ট করলেই হয়।
ক্যান্টিনে সবথেকে বেশী ভিড় হয় দুপুর ১২টা আর বিকেল ৬টার সময়। ওই সময় ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস শেষ হয়। যতক্ষণ খাবার সময় চলে, একজন সুপারভাইজার সব সময় ঘুরে ঘুরে তদারক করেন। ক্যান্টিনের ভেতরে যেখানে রান্না হয়, সেখান থেকে লাইভ CCTV ফিড ক্যান্টিনের দেওয়ালে লাগানো বড় বড় TV তে চলতে থাকে সারাক্ষণ। ইউনিভার্সিটির সব কটা ক্যান্টিন এই একই পদ্ধতিতে চলে।
Comments