চীনের শিক্ষা ব্যবস্থা
- Achyut
- Nov 4, 2023
- 9 min read
চীন দেশে কাটিয়ে ফেললাম প্রায় ছ'টা বছর। এই কটা বছরে কত ছাত্রছাত্রীকে দেখলাম ইউনিভার্সিটিতে আসতে, পড়াশুনো শেষ করে চলেও যেতে। যাবার আগে তাদের সাথে তোলা ছবিগুলো সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থেকে গেলো। আগে থাকতাম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে, এখন থাকি ইউনিভার্সিটি থেকে একটু দূরে একটা এপার্টমেন্টে। এই এপার্টমেন্টের দেওয়ালের ঠিক বাইরে রয়েছে একটা স্কুল। রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গে স্কুলের ঘণ্টায়। অফিসে না গিয়ে কোনোদিন বাড়িতে থাকলে কানে আসে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের গলার আওয়াজ। তাই এতোগুলো বছর পড়াশুনোর এতোটা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটানোর পর খুব জানার ইচ্ছে হয় - কেমন হয় এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এই লেখায়।
এই লেখায় থাকছেঃ
১। কতগুলো স্তর থাকে চীনের শিক্ষা ব্যবস্থায়? কতদূর অবধি পড়াশুনো বাধ্যতামূলক?
২। স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা যায় কি ভাবে? কেমন হয় পৃথিবীর অন্যতম কঠিন স্কুল পরীক্ষা?
৩। কি রকম খরচ হয় দেশের প্রথম সারির ইউনিভার্সিটিতে পড়তে? কি কি স্কলারশিপ পাওয়া যায়? বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য কি ব্যবস্থা?

চীনের ছয় স্তরীয় শিক্ষা ব্যবস্থা
চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাধারণত ছটা ভাগে ভাগ করা যায় - প্রাইমারী, লোয়ার সেকেন্ডারি, আপার সেকেন্ডারি, ব্যাচেলর ডিগ্রী, মাস্টার্স ডিগ্রী, এবং ডক্টরেট ডিগ্রী।
প্রাইমারী স্কুল
ক্লাসঃ ১-৬
বয়সঃ ৬-১২
সময়ঃ ৬ বছর
চীন দেশে ছ'বছরের প্রাইমারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক। এখানে বাচ্চারা ছ'বছর বয়সে স্কুল শুরু করে, যদিও কোন কোন জায়গায় স্কুল শুরুর বয়স সাত। পড়াশুনোর মাধ্যম ম্যান্ডারিন ভাষা। তবে এখানেও ব্যতিক্রম রয়েছে। যে সব স্কুল সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য, সেখানে তাদের নিজস্ব ভাষায় পড়ানো হয়। একটা শিক্ষাবর্ষ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস অবধি হয়, যাতে দুটো সেমিস্টার থাকে। সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হয়।
ন'টা আবশ্যিক বিষয় থাকেঃ চীন ভাষা (Chinese), অঙ্ক (Mathematics), সামাজিক অধ্যয়ন (Social Studies), প্রকৃতি (Nature), শারীরিক শিক্ষা (Physical Education), মতাদর্শ এবং নৈতিকতা (Ideology and Morality), সঙ্গীত (Music), চারুকলা (Fine Art), এবং শ্রম অধ্যয়ন (Labor Studies)। বিদেশী ভাষা শিক্ষা সাধারণত বিকল্প কোর্স হিসাবে থাকে। সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে চীন ভাষা এবং অঙ্ক - এই দুটো বিষয়ে পাস করতে হয়। পরীক্ষা নেওয়া হয় স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায়। প্রাইমারী স্কুল থেকে পাস করে ছাত্রছাত্রীরা চলে যায় লোয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে।
লোয়ার সেকেন্ডারি বা নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল
ক্লাসঃ ৭-৯
বয়সঃ ১২-১৫
সময়ঃ ৩ বছর
তিন বছরের লোয়ার সেকেন্ডারি বা নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা এখানে বাধ্যতামূলক।
এখানে ছ'টা আবশ্যিক বিষয় থাকেঃ চীন ভাষা (Chinese), অঙ্ক (Mathematics), রসায়ন (Chemistry), পদার্থবিজ্ঞান (Physics), বিদেশী ভাষা (Foreign Language) এবং রাজনীতি (Politics)। এই পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়াশুনোর পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের ন্যূনতম শারীরিক পরীক্ষাতেও পাস করতে হবে। পরীক্ষা নেওয়া হয় প্রাদেশিক শিক্ষা ব্যুরো বা স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায়। এই পরীক্ষায় পাস করলে ন'বছরের (ছ'বছর প্রাথমিক শিক্ষা + তিন বছর নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা) বাধ্যতামূলক শিক্ষা শেষ হয়।
আপার সেকেন্ডারি বা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল
ক্লাসঃ ১০-১২
বয়সঃ ১৫-১৮
সময়ঃ ৩ বছর
লোয়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে পাস করার পরে ছাত্রছাত্রীদের সামনে দুটো অপশন থাকে -
এক, সাধারণ বা একাডেমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, আর
দুই, বৃত্তিমূলক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল।
একাডেমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, বা gaozhong, তিন বছরের জন্য, আর বৃত্তিমূলক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, বা zhongzhuan, চার বছরের। একাডেমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ঢোকার জন্য একটা প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়, এখানে যার নাম zhongkao। এই পরীক্ষা পরিচালনা করে প্রাদেশিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষ। এই পরীক্ষায় নিম্ন মাধ্যমিকের সব বিষয় থাকে। পরীক্ষায় পাস করে উচ্চ মাধ্যমিক সস্কুলে ঢোকার পর ছাত্রছাত্রীদের নিম্ন মাধ্যমিকের বিষয় গুলো আরও বিশদে পড়ানো হয়। স্কুল শেষের পরীক্ষার পর যদি ছাত্রছাত্রীরা ইউনিভার্সিটিতে যেতে চায়, তার জন্য হয় জাতীয় উচ্চশিক্ষা প্রবেশিকা পরীক্ষা, বা National College Entrance Examination (NCEE), স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় gaokao।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রোগ্রামগুলো হয় বিষয় এবং কর্মসংস্থানকে মাথায় রেখে। এই পরীক্ষায় পাস করে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। ২০০০ সালের আগে এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষায় যাবার পথ ছিল না। তবে এখন এই ছাত্রছাত্রীরাও NCEE পরীক্ষায় বসতে পারে, আর পাস করলে উচ্চশিক্ষা প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারে।
উচ্চ শিক্ষা
ব্যাচেলর ডিগ্রী
ক্লাসঃ ১৩-১৬
বয়সঃ ১৮-২২
সময়ঃ ৪ বছর
মাস্টার্স ডিগ্রী
ক্লাসঃ ১৭-১৮
বয়সঃ ২২-২৪
সময়ঃ ২-৩ বছর
ডক্টরেট ডিগ্রী
ক্লাসঃ ১৯-২১
বয়সঃ ২৪-২৭
সময়ঃ ৩ বছর
চীনে উচ্চশিক্ষা দিতে পারে বেশ কয়েক রকমের প্রতিষ্ঠান - যেমন সাধারণ ইউনিভার্সিটি, পেশাদার ইউনিভার্সিটি, সামরিক প্রতিষ্ঠান, মেডিকেল স্কুল এবং কলেজ, এবং বেশ কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।ইউনিভার্সিটিতে ঢোকা নির্ভর করে NCEE পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। তাই এখানে NCEE পরীক্ষা খুব কম্পিটিটিভ হয়। ভালো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে গেলে NCEE পরীক্ষায় ভালো র্যাঙ্ক থাকা দরকার। তবে কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে দারুণ ভালো পারফরম্যান্স করলে ছাত্রছাত্রীরা NCEE পরীক্ষা না দিয়েও নিজেদের পছন্দ মতো ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেতে পারে, এই পদ্ধতির নাম baosong। এছাড়াও কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠান NCEE পরীক্ষার ফলাফলের বাইরে ছাত্রছাত্রী নিতে পারে, যদি তারা সমস্ত টিউশন ফি দিতে পারে।
NCEE পরীক্ষা
আগেই বলেছি, চীনের National College Entrance Examination এমন একটা পরীক্ষা যেটাতে দেশের সমস্ত চূড়ান্ত বর্ষের স্কুল শিক্ষার্থীদের পাস করতেই হবে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করতে গেলে। NCEE কে মনে করা হয় পৃথিবীর অন্যতম কঠিন স্কুল পরীক্ষা হিসেবে। জুন মাসের শুরুতে এই পরীক্ষা হয়, যখন পুরো দেশে প্রায় লকডাউনের মতো অবস্থা হয় এতো সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা হলে যাবার জন্য। যে কোন পরিবহণ মাধ্যমে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এমনকি মেট্রোতে তাদের যাতায়াত বিনামূল্যে করে দেওয়া হয়। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয় পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে।
পরীক্ষার বিষয় বিভিন্ন প্রদেশে আলাদা হয়, তবে সাধারণত চীন সাহিত্য, অঙ্ক, এবং একটি বিদেশী ভাষা (সাধারণত ইংরেজি) পরীক্ষার বিষয় হিসেবে থাকে। লিবারেল আর্টস বিষয়ের ক্ষেত্রে ইতিহাস, রাজনীতি এবং ভূগোলের পরীক্ষা দিতে হয়, আর বিজ্ঞানের জন্য পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানে পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় multiple choice এবং essay - দু'ধরনের প্রশ্নই থাকে। পরীক্ষা চলে প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে। এই সময়টাকে ভাগ করা হয় দু'দিনে, বা কোন কোন ক্ষেত্রে তিন দিনেও।
পরীক্ষায় বসার আগে পরীক্ষার্থীদের একটি ফর্ম পূরণ করতে হয় যাতে তারা যে ইউনিভার্সিটিগুলোতে যেতে চায়, তার নাম দিতে হয়। প্রতিটা ইউনিভার্সিটির একটা ন্যূনতম ইনটেক স্কোর থাকে। যদি পরীক্ষার্থী সেই স্কোর করে, তবেই সে ওই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকতে পারবে। আর তা না হলে, তাদের লিস্টে থাকা অন্য ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো হয়। এবার ধরা যাক, আমি পরীক্ষায় বসার আগে ৫টা ইউনিভার্সিটির নাম দিলাম। তাদের ন্যূনতম ইনটেক স্কোর হল যথাক্রমে ১০, ৯, ৮, ৬, এবং ৫। আমি NCEE পরীক্ষায় পেলাম ৪। তাহলে আমি এই বছর কোন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকতে পারবো না। পরের বছর আবার আমাকে NCEE পরীক্ষা দিতে হবে। চীনে NCEE পরীক্ষা দেবার কোন বয়স সীমা নেই, এবং একজন পরীক্ষার্থী অনেকবার এই পরীক্ষায় বসতে পারে।
বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের চীনের ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করতে গেলে NCEE পরীক্ষা দিতে হয় না। এর জন্য প্রত্যেক ইউনিভার্সিটির নিজস্ব পরীক্ষা ব্যবস্থা আছে। এই পরীক্ষা কিন্তু NCEE এর মতো এতো কঠিন হয় না।
NCEE কে মনে করা হয় এতো বড় একটা দেশে সমস্ত শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার একই রকম সুযোগ দেওয়ার সবথেকে ভালো মাধ্যম। কিন্তু কিছু সমালোচনা তো থাকবেই। সব থেকে বড় যে বিষয়টা সমালোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে তা হল, পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের স্ট্রেস এবং উদ্বেগ এবং পরীক্ষার পরে হতাশা। দ্বিতীয় হল পারিবারিক চাপ, যেখানে অনেক বাবা-মা আশা করেন যে তাদের সন্তানরা ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশোনা করবে। অনেক বাবা-মা এই পরীক্ষাকে শুধু ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, তাঁদের মতে এই পরীক্ষা ঠিক করে দেয় তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ - তারা কোথায় চাকরি করবে, কি রকম হবে তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা, সব কিছুই তাঁরা এই পরীক্ষার সাথে জড়িয়ে ফেলে তাঁদের সন্তানদের ওপর আরও চাপ বাড়িয়ে দেন।
প্রথম সারির ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো
(এখানে সমস্ত খরচের হিসেব RMB তে দেওয়া
১ RMB মানে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০ টাকা)
এবার একটু দেখা যাক, কি রকম হয় এখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করার টিউশন ফি। আমি যে ইউনিভার্সিটির সাথে যুক্ত, সেই সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটি চীনের প্রথম সারির ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে একটা। তাই এখানে তিন ধরণের কোর্সে পড়াশুনোর কিরকম খরচ হয়, সেটা দেখলে চীনের উচ্চশিক্ষার খরচ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
স্নাতক বা Undergraduate কোর্স
২০২৩ সালে এই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় ৭,৭৩০ জন শিক্ষার্থী। বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০০ আসন ধরা ছিল। দেশের সব প্রদেশ থেকে যাতে ছাত্রছাত্রীরা এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারে, তাই প্রতিটা প্রদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটা কোটা বরাদ্দ থাকে। এই সংখ্যা নির্ধারিত হয় প্রতিটা প্রদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে এবং শিক্ষার্থীদের পরিমাণ এবং গুণমান দেখে। তবে এই সংরক্ষিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মোট সংখ্যার এক শতাংশের বেশী হয় না।
আগে লিখেছি, NCEE তে পাশ করা প্রথম এক শতাংশ ছাত্রছাত্রী এখানে পড়াশুনো করার সুযোগ পায়। যদি দুজনের স্কোর একই হয়, সেক্ষেত্রে প্রদেশ ভিত্তিক স্কোর হিসেবে নির্বাচন করা হয়। তবে শুধুমাত্র NCEE এর স্কোর না, তার সাথে দেখা হয় আবেদনকারীর মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক চরিত্র এবং শারীরিক পরীক্ষার স্কোর।
সঙ্গীত বাদে সমস্ত স্নাতক স্তরে একজন শিক্ষার্থীর এক বছরে টিউশন ফি ৫৪৮০-৮০০০ RMB। এর সাথে হস্টেল ফি ৭৫০-১৬০০ RMB প্রতি বছরে। সঙ্গীতের জন্য একজন শিক্ষার্থীর এক বছরে টিউশন ফি ১০০০০ RMB।
স্নাতকোত্তর বা Postgraduate কোর্স
চীনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীতে ভর্তির যোগ্য হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ডিসেম্বরের শেষের দিকে একটি লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়, তারপর পরের বছরের মার্চ মাসে হয় একটা ইন্টারভিউ। এই পরীক্ষার সেন্টার পরে সাধারণত শিক্ষার্থীর নিজের প্রদেশে, তবে অন্য প্রদেশ থেকেও এই পরীক্ষা দেওয়া যায়। এর পর দেশের Ministry of Education একটা ন্যুনতম স্কোর প্রকাশ করে, যার ভিত্তিতে স্নাতকোত্তর কোর্সে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। তবে স্নাতক স্তরে দারুণ ভালো রেজাল্ট হলে এই পরীক্ষা থেকে ছাড় পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি ভর্তি হয়ে যাওয়া যায়। এই ছাড় শুধুমাত্র নতুন স্নাতকরাই পেয়ে থাকে।
সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটিতে এই বছর, মানে ২০২৩ সালে, প্রায় ৮০০০ জন স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় - একাডেমিক এবং বৃত্তিমূলক দু'রকমের কোর্সেই। একজন শিক্ষার্থীর এক বছরে টিউশন ফি এরকমঃ
একাডেমিকঃ ৮০০০ RMB
বৃত্তিমূলকঃ ২২৫০০ RMB
MBA: ৩৫০০০ RMB
Statistics, Accounting, Engineering Management: ২২৫০০ RMB
Applied Psychology, Library and Information Science: ২২০০০ RMB
Laws: ২২০০০ RMB
Medical: ১৫০০০-২০০০০ RMB
Arts: ৩০০০০ RMB
Engineering: ১০০০০-২০০০০ RMB
Agriculture and Urban Planning: ৮০০০-১০০০০ RMB
হস্টেল ফি ১৫০০-৩৬০০ RMB প্রতি বছরে, ঘরের আকার আয়তনের ওপর নির্ভর করে।
ক্লাসরুম পড়াশুনো ছাড়াও, স্নাতকোত্তর কোর্সে একটা বিষয়ের ওপর গবেষণা করে থিসিস লিখতে হয়। এই গবেষণার কাজের সময়কাল এক বছর। এই থিসিস অন্য ইউনিভার্সিটির দু'জন শিক্ষক মূল্যায়ন করেন। তাঁদের মূল্যায়নের পর শিক্ষার্থীকে নিজের থিসিস এই ইউনিভার্সিটির একটা কমিটির সামনে প্রেজেণ্ট করতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, এই কমিটিতে অন্তত তিন জন শিক্ষক থাকবেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত একটা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেওয়া হয়। কমিটির সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ একমত হলে সেই সিদ্ধান্ত একাডেমিক ডিগ্রি মূল্যায়ন কমিটির কাছে জমা দিতে হয়। সেখানেও একই নিয়ম। সেই কমিটিতেও সিদ্ধান্ত হবে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। কমিটির সদস্যদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলে তবেই শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।
এখানে স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা একটা ফেলোশিপ পায়। ফেলোশিপের টাকার অঙ্কটা নির্ভর করে দুটো জিনিসের ওপর। শিক্ষার্থীদের গবেষণা এবং প্রতি বছরের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে তাদের তিনটে গ্রেডে ভাগ করা হয় -
প্রথম গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ১০০০ RMB এবং বছরের শেষে অতিরিক্ত ৮০০০ RMB
দ্বিতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ৬০০ RMB এবং বছরের শেষে অতিরিক্ত ৮০০০ RMB
তৃতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ৫০০ RMB
ডক্টরেট ডিগ্রী
চীনে দু'রকমের পি এইচ ডি হয় - একাডেমিক এবং বৃত্তিমূলক।বৃত্তিমূলক পি এইচ ডি এর জন্য শুধুমাত্র আবেদন করতে হয় এবং একটা ইন্টারভিউ এর পরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। কিন্তু একাডেমিক পি এইচ ডি এর ক্ষেত্রে পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষার স্থানীয় ভাষায় নাম kaobo।
এর তিনটে ধাপঃ
বিষয় এবং ইউনিভার্সিটি ঠিক করা। এই পরীক্ষা যেহেতু নেয় ইউনিভার্সিটি, তাই সেই ইউনিভার্সিটির নিয়ম কানুন সম্পর্কে জানা।
যে শিক্ষকের কাছে পি এইচ ডি করবে, তাঁর সাথে যোগাযোগ করা।
পরীক্ষার জন্য আবেদন করা।
kaobo পরীক্ষা হয় মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে। সান ইয়াট-সেন ইউনিভার্সিটির মতো কোন কোন ইউনিভার্সিটি দ্বিতীয় বার পরীক্ষা নেয়। এই পরীক্ষা সাধারণত ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সাথে ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে করা হয়।
পরীক্ষায় পাস করে ইউনিভার্সিটি তে ঢোকার পর, গবেষণার পাশাপাশি তিনটে কোর্স করতে হয় - দুটো পেশাদার বা professional কোর্স, আর একটা ভাষার কোর্স। পেশাদার কোর্সে থাকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব এবং ব্যবসায়িক কোর্স। ভাষার কোর্স সাধারণত ইংরেজি হয়ে থাকে। লিখিত এবং মৌখিক -দু'রকমের পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষাতে পাস করলে কোর্সের কাজ শেষ হয়।
এর সাথে চলতে থাকে গবেষণার কাজ। চীনে ডক্টরেট ডিগ্রীর সময়কাল সাধারণত তিন বছর। ডক্টরেট ডিগ্রী পাবার জন্য তিনটে ধাপ থাকেঃ
নিজের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে অন্তত একটা পেপার পাবলিশ করতে হয় কোন আন্তর্জাতিক জার্নালে। এই পেপারে শিক্ষার্থীর নাম সবার প্রথমে থাকতে হবে। একে বলে first authorship paper।
গবেষণা শেষ করে একটা থিসিস বানাতে হয়। এই থিসিস অন্য ইউনিভার্সিটির তিনজন শিক্ষক মূল্যায়ন করেন। এই শিক্ষকদের নাম শিক্ষার্থীর জানা থাকে না। এই শিক্ষকরাও নিজেদের নাম জানাতে পারেন না। একে বলা হয় double blind peer review।
এর পর আসে থিসিস ডিফেন্স। শিক্ষার্থীকে নিজের থিসিস এই ইউনিভার্সিটির একটা কমিটির সামনে প্রেজেণ্ট করতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, এই কমিটিতে অন্তত তিন জন শিক্ষক থাকবেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত একটা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেওয়া হয়। কমিটির সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ একমত হলে সেই সিদ্ধান্ত একাডেমিক ডিগ্রি মূল্যায়ন কমিটির কাছে জমা দিতে হয়। সেখানেও একই নিয়ম। সেই কমিটিতেও সিদ্ধান্ত হবে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। কমিটির বেশীর ভাগ সদস্য একমত হলে তবেই শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় ডক্টরেট ডিগ্রী।
এখানে কিন্তু ডক্টরেট ডিগ্রীতে পড়াশুনো করতে টাকা দিতে হয়। খরচটা একজন শিক্ষার্থীর এক বছরে এরকমঃ
একাডেমিক ক্ষেত্রে পি এইচ ডি - ১০০০০ RMB
বৃত্তিমূলক ক্ষেত্রে পি এইচ ডি - ২০০০০ RMB
কোর্স ফি - ২০০০ RMB প্রতি কোর্স
স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর মতো হস্টেল ফি ১৫০০-৩৬০০ RMB প্রতি বছরে, ঘরের আকার আয়তনের ওপর নির্ভর করে।
এখানে ডক্টরাল ডিগ্রীর ছাত্রছাত্রীদের ফেলোশিপের টাকার অঙ্কটা নির্ভর করে পি এইচ ডি কোর্সে ফলাফল এবং গবেষণা পেপারের সংখ্যার ওপরে। সেই মতো শিক্ষার্থীদের তিনটে গ্রেডে ভাগ করা হয় -
প্রথম গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ৫০০০ RMB এবং বছরের শেষে অতিরিক্ত ২০০০০ RMB
দ্বিতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ৪৩০০ RMB এবং বছরের শেষে অতিরিক্ত ১০০০০ RMB
তৃতীয় গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পায় প্রতি মাসে ৩৫০০ RMB এবং বছরের শেষে অতিরিক্ত ১০০০০ RMB
বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য
স্নাতক স্তরের বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবস্থা অন্যরকম। প্রথমে দেখা যাক কি কি লাগে আবেদন করতেঃ
১। পাসপোর্ট
২। স্কুল সার্টিফিকেট
৩। অর্থনৈতিক প্রমাণ (অন্তত ১০০০০০ RMB ব্যাঙ্কে থাকার প্রমাণ)
৪। রেকমেন্ডেশন লেটার
৫। চাইনীজ ভাষা জানার প্রমাণ পত্র (অন্তত HSK লেভেল ৫)
৬। নিজের সম্পর্কে একটা চিঠি
৭। শারীরিক পরীক্ষার ফলাফল
৮। নন - ক্রিমিনাল রেকর্ড
৯। স্কলারশিপ ফর্ম
অনলাইনে ফর্ম জমা দেবার পর ইউনিভার্সিটি সেই ফর্ম এবং তার সাথে জমা দেওয়া সমস্ত কাগজ খুঁটিয়ে দেখে আবেদনকারীকে ডাকে ইন্টারভিউতে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়া হয় আবেদন পত্র এবং ইন্টারভিউ এর রেজাল্টের ওপর নির্ভর করে। এর সাথে দেওয়া হয় স্কলারশিপের অপশন। বিভিন্ন স্কলারশিপ আছে এখানে, যেমন
Chinese Government Scholarship,
SYSU 'Belt and Road' Scholarship,
Guangdong Government Outstanding International Student scholarship ইত্যাদি।
স্কলারশিপ পাওয়া না পাওয়া ইউনিভার্সিটির হাতে নয়, সেটা ঠিক করে স্কলারশিপ যে সংস্থা দিচ্ছে, সেই সংস্থা।
স্কলারশিপ প্রায় সব বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের জন্য দরকার হয়, কারণ এখানকার পড়াশুনোর খরচ। একজন শিক্ষার্থীর এক বছরে টিউশন ফি এরকমঃ
Liberal Arts, Economics, Management: ২৬০০০ RMB
Natural science, Engineering: ৩৩৮০০ RMB
Medical Science: ৪৮০০০ RMB
সমস্ত কোর্সে আবেদনের জন্য লাগে ৪০০ RMB।
যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী স্কলারশিপ পায় না, তাদের ইউনিভার্সিটির বাইরে নিজেদের থাকার জায়গা ঠিক করে নিতে হয়। এছাড়া এই দেশের নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ইনসিওরেন্স করাতে হয়।
স্নাতকোত্তর স্তরে ওপরের এই নিয়ম গুলো প্রায় সব এক থাকে। শুধু ইন্টারভিউ এর সাথে একটা লিখিত পরীক্ষা হয়। স্নাতকোত্তর স্তরে খরচ এরকমঃ
Humanities: ৩০০০০ RMB
Natural science, Engineering: ৩৯০০০ RMB
Medical science: ৫৫০০০ RMB
MBA: ৯০০০০ RMB
এখানে যে স্কলারশিপগুলোর জন্য আবেদন করা যায়, সেগুলো হলঃ
Chinese Government Scholarship -Bilateral Program
Chinese Government Scholarship – High-Level Graduate Program
International Chinese Language Teachers Scholarship
Master's in Public Administration of the China Governance Program of the Ministry of Commerce of China
Guangdong Government Outstanding International Student Scholarship।
এখানে পি এইচ ডি করতে হলে স্নাতকোত্তর স্তরের মতো সব জিনিস লাগে। আর তার সাথে লাগে পড়াশুনো এবং গবেষণার একটা প্ল্যান। আবেদনকারীদের বেছে নেওয়া হয় ইন্টারভিউ এবং একটা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে। এই পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ নেয় শিক্ষার্থী যে ডিপার্টমেন্টে আবেদন করেছে, সেই ডিপার্টমেন্ট। এখানে পি এইচ ডি করতে খরচ এরকমঃ
Liberal arts, Economics, Management: ৩৪০০০ RMB
Natural science, Engineering: ৪৪২০০ RMB
Medical science: ৬৫০০০ RMB
স্নাতকোত্তর স্তরের সব স্কলারশিপ পি এইচ ডি করার জন্যও রয়েছে। এছাড়াও আছে China Studies Program (CSP) – Ph.D. Fellowships।
Comments