top of page

একদিনে প্যারিস - পর্ব ২

  • Writer: Achyut
    Achyut
  • Sep 30, 2023
  • 5 min read

আজ 'একদিনের প্যারিস' এর দ্বিতীয় পর্বে চীন থেকে প্যারিস পৌঁছনো। এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেন ধরে হোটেলে পৌঁছনো আর তারপর সেই রাতেই শহরটাকে প্রথম দেখা - সব অভিজ্ঞতা থাকছে এই পর্বে।


কি ভাবে পৌঁছলাম প্যারিস


এই করতে করতে এসে পরল যাবার দিন। দিনটা ১০ই নভেম্বর। সকালে ৮ টা ১০ এর ফ্লাইট গুয়াংজু থেকে, প্রথমে যাওয়া বেজিং, সেখান থেকে প্যারিস। আমার সঙ্গের লাগেজ বলতে একটা পিঠের ব্যাগ যাতে আমার ক্যামেরা আছে, একটা ল্যাপটপ ব্যাগ যাতে ল্যাপটপের সাথে পাসপোর্ট আছে, আর একটা ট্রলি যাতে আমি ভরেছি শুধু গরম জামা। যখন দেখেছি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তাপমাত্রা ঘোরাঘুরি করছে ৭-১০ ডিগ্রির ভেতরে, এবং আগামী দিনগুলোতে সেটা আরও কমবে, তখন তড়িঘড়ি গিয়ে একটা জ্যাকেট কিনে এনেছি। আমাদের ইউনিভার্সিটির সামনে থেকে এয়ারপোর্ট যাবার বাস ছাড়ে। সকালের প্রথম বাসে চেপে বসলাম, তখন ঘড়িতে বেজেছে ৫ টা। শহর তখনও উঠিউঠি করছে, রাস্তায় কিছু মালবোঝাই লরি শহরের খাদ্যের আয়োজনে ব্যস্ত। একজন স্টুডেন্ট এসেছিল আমাকে বাসে তুলে দিতে, দরকার ছিল না, কিন্তু আমার বসের হুকুম সেই ছেলেটিই বা অমান্য করে কি করে। তাকে টাটা করে বাস চলল এয়ারপোর্ট এর দিকে, গুটিকয়েক যাত্রীকে সঙ্গী করে।

নির্দিষ্ট সময়ে প্লেন ছাড়ল, ১১ টায় বেজিং পৌঁছে ট্রান্সিট, হাতে সময় আড়াই ঘণ্টা মতো। তাড়াহুড়ো করে পরের প্লেন এর চেক ইন সারলাম, মাথায় তখন খালি ঘুরছে শেষ বার চীনে এসে প্লেন মিস করার কথা, এই একই কারনে। যাই হোক, সময় মতো সব হলও, প্যারিস এর প্লেন ছাড়ল ঘড়িতে তখন দুপুর ১ টা বেজে ৩০ মিনিট। সামনে লম্বা যাত্রাপথ – প্রায় ৫০০০ মাইল পথ পাড়ি দেবে এই এয়ারবাস ১১ ঘণ্টায়। তাই সিট নিয়েছিলাম চলাচল করার করিডরের পাশে, যাকে ইংরাজিতে বলে aisle। সামনের সিট এর সারি ফাঁকা আর তার সামনে বেশ কিছুটা খোলা জায়গা। তিন জনের সিটে আমার পাশে দুটো মেয়ে – দুজনেই আমার সমবয়সী এবং কথা থেকে বোঝা যায়, তারা ফ্রান্স এরই অধিবাসী। ইউরোপিয়ান চরিত্রের নমুনা মিলল যাত্রাপথেই।


রোদের পথ আটকে ঘুমোচ্ছিল মেয়ে দুটো। যাত্রা পথের একঘেয়েমি দূর করতে পেছনের যাত্রীদের কেউ কেউ উঠে আসছিলেন সামনের খোলা জায়গাটায়। এদেরই একজন আমাদের সামনের ফাঁকা সিটে বসে জানালাটা খুলে দিচ্ছিলেন, আর যার ফলে সুযোগ পেয়ে বাইরের সূর্য ঢুকে পড়ছিল ভেতরে। ঘুমের ব্যাঘাত হতে আমার পাশের সহযাত্রীটি দু'বার বিরক্তি সূচক শব্দ করলেন, তিন বারের বার আর থাকতে না পেরে জানালাটাই ধরে বেশ জোরের সাথেই দিলেন নামিয়ে। ভাষা যেখানে মত প্রকাশের অন্যতম অন্তরায়, সেখানে এই আচরণ হয়তো বা সঙ্গত, কিন্তু ভাবলাম – আমরা পারতাম কি প্রথমেই এই আচরণ করতে নাকি বোঝানোর চেষ্টাতে কিছুটা সময় খরচ করতাম আগে? যেখানে আমি যাচ্ছি, এই নমুনা কি সেই সমগ্র জাতির ব্যবহারের প্রতিনিধি? অপেক্ষা তো আর কয়েক ঘণ্টার, তারপর দেখবো। ততক্ষণ আমি মন দিলাম খাবারে – স্বীকার করতেই হবে এয়ার চায়না খেতে দেয় ভালই, আর অনেকবার। ওঠার পর লাঞ্চ, তারপর স্ন্যাক্স, আবার নামার আগে ডিনার। আর এর মাঝে ড্রিংক, যাতে নরম থেকে গরম সব রকম পানীয়ই থাকে। এই সব খেয়েও আমি উঠে গিয়ে এয়ারহোস্টদের কেবিন থেকে চার বার কফি খেয়ে এসেছি।


এয়ারপোর্ট থেকে শহর, ট্রেনে করে


একঘেয়ে যাত্রাও একসময় শেষ হল, ঘড়িতে দেখি রাত ১ টা। সময়ের পার্থক্যটা আগে থেকেই হিসেব করা ছিল, একদিন পিছিয়ে গেছি, এখন এখানে বেজেছে বিকেল ৬ টা। প্লেন থেকে বেরিয়ে লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে লেগে গেলো আরও ঘণ্টা খানেক। এরপর ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতে লাগল আরও আধঘণ্টা মতো। এয়ারপোর্ট টার্মিনাল ২ থেকে স্বয়ংক্রিয় ট্রেনে চেপে বিনামুল্যে চলে আসা যায় টার্মিনাল ৩ যেখান থেকে RER-B লাইন এর ট্রেন ছাড়ে। ভাড়া ১০ ইউরো। হাতে টিকিট নিয়ে কলকাতা মেট্রোর মতো মেশিনে ঢুকিয়ে ঘোরানো গেট পেরিয়ে পা রাখলাম ট্রেন স্টেশনে।


A train station
Train Station in Paris Airport

স্টেশনটা নিচে, তার দুটো প্ল্যাটফর্ম – একটাতে ট্রেন শহরে যায়, আর একটা দিয়ে এয়ারপোর্টে আসে। স্টেশনের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে সময় গুলো দেখে বুঝলাম এখানে দুরকমের ট্রেন আছে – একটা হাইস্পিড যেটা সব স্টেশনে থামবে না, আর একটা রেগুলার। আমার গন্ত্যব্যে দুরকম ট্রেনই যাবে, তাই প্রথম রেগুলার ট্রেনটা ছেড়ে দিলাম। মাঝের সময়টা প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করে কাটাতে গিয়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়লো। ওপরে এয়ারপোর্ট চত্বর যেন আধুনিক প্যারিসের প্রতিনিধি আর নিচে আধো অন্ধকারে ছেয়ে থাকা ট্রেন স্টেশন, লাইনের পাশের নোনা ধরা দেওয়াল, স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে – যেন প্রথম পরিচয় করায় শহরের আত্মার সাথে, মনে করিয়ে দেয় আমি এসেছি সেই শহরে যা আজও তার প্রাচীনত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত। ওপরের শহরের আলোকজ্জ্বল আধুনিকতার নিচে একটুকরো পুরনোকে বুকে জড়িয়ে সে আজও সাক্ষ্য দেয় পুরনো প্যারিসের যার জন্ম সেই ২৫৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে PARISSI নামক এক উপজাতির হাত ধরে।

ট্রেন এলো যথাসময়ে, আর আমিও আমার জিনিসপত্র নিয়ে চেপে বসলাম তাতে। ঘড়িতে তখন প্রায় ৮ টা। স্টেশনের পর স্টেশন ছাড়িয়ে চললাম। ট্রেনে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মিলিয়ে যাত্রী খুব অল্প নয়, লোক উঠছে-নামছে, আমার চোখ মোবাইল এর স্ক্রিনে, জানি কখন আমায় নামতে হবে। Gare du Nord (এখান থেকেই ছাড়ে Euro star ট্রেন, যা লন্ডন আর প্যারিস কে যুক্ত করে) আর Chatelet Les Halles স্টেশন এর পর এলো St Michel-Nôtre Dame স্টেশন। নেমে পড়লাম, নির্দেশিকা অনুসরণ করে বেরুলাম Saint-Germain Boulevard এ।


মাটির তলা দিয়ে লম্বা পথ পেরিয়ে আসতে লাগল প্রায় মিনিট পাঁচেক। আর বেরিয়েই বুঝতে পারলাম ঠাণ্ডাটা। ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর কেঁপে উঠল, গায়ের পুলওভার টা গলা অবধি টেনে ওপরে এসে দাঁড়ালাম। যেখানে বেরুলাম, সেই জায়গাটা একটা চৌমাথা। ম্যাপটা মোটামুটি মাথায় ছিল, সেই মতো দিক আন্দাজ করে হাঁটা শুরু করলাম। চৌমাথা থেকে বাঁদিকে Saint-Germain Boulevard ধরে মিনিট পাঁচেক মতো হেঁটে আবার বাঁদিকে বেঁকে কিছুটা গিয়ে একটা ছোট রাস্তা ডানদিকে ঢুকে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে ডান হাতে পড়ল হোটেলটা - Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés। হোটেলের সামনের রাস্তায় বোধহয় গাড়ির পারকিং, সরু রাস্তার বাঁদিকে সোজা উঠে গেছে ৫ তলা বাড়ি যার বিস্তৃতি রাস্তার এই মাথা থেকে ওই মাথা। ম্যাপে দেখলাম সেটা University Paris-Sorbonne। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ৯ টা।


সেই রাতেই প্রথম শহরটাকে দেখা


হোটেলের পেমেন্ট করাই ছিল, বাকি ফর্মালিটি সেরে ঘরে ঢুকে পরলাম। বেশ সাজানো গোছানো হোটেল, তিন তারা হোটেলের মতই। ঘরে ঢুকে বাড়িতে জানিয়ে প্রথম এক কাপ কফি বানালাম হোটেলের ইলেকট্রিক কেটলিতে। যদিও কেটলি, কফি, চিনি সবই আমার ব্যাগে ছিল, সেগুলো বের না করে হোটেলের জিনিসগুলো দিয়েই কাজ সারলাম। কফি খেয়ে, হাত মুখ ধুয়ে, একটু ফ্রেশ হয়ে ১৫ মিনিট পরে আবার বেরুলাম।


A room in hotel in Paris
Hotel Room in Hotel Mercure La Sorbonne Saint-Germain-des-Prés, Paris

যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেটা ধরেই গেলাম, চৌমাথা ছাড়িয়ে সোজা এগোলাম। রাস্তার দু পাশে দোকানের সারি, এই রাতে সবই প্রায় বন্ধ, রাস্তায় টুরিস্ট ও প্রায় নেই বললেই চলে। এই জায়গা থেকেই শুরু বিখ্যাত ল্যাটিন কোয়াটার। হোটেল থেকে বেরিয়ে ৫০০ মিটার হেঁটে আসতেই দেখতে পেলাম একটা ব্রিজ, তলা দিয়ে বয়ে চলেছে সেইন নদী। রাস্তাটা এখানে অনেকটা চওড়া, ব্রিজের আগে দুভাগে ভাগ হয়ে নদীর পাশ বরাবর চলে গেছে দুদিকে। ম্যাপে দেখলাম এই ব্রিজটার নাম Pont Saint-Michel। যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে এই ত্রিমাথা, তার একটু আগেই একটা ত্রিভুজ রাস্তার মাঝখানে, দুদিক দিয়ে রাস্তা এসে একজায়গায় মিললে যেমন হয়, তেমন। আর সেই ত্রিভুজের মাঝখানে একটা ফোয়ারা, যার নাম Fontaine Saint-Michel। ১৮৬০ সালে গ্যাব্রিয়েল দেভিউডের বানানো এই স্থাপত্যের মাঝখানে সেন্ট মাইকেলের ব্রোঞ্জের মূর্তি যার হাতে উদ্যত তরবারি প্রস্তুত পায়ের নিচের অসুর বা ডিমন বধের জন্য। দুদিক দিয়ে উঠেছে চারটে লাল মার্বেলের স্তম্ভ যা প্রতিনিধিত্ব করছে চারটে গুণের – ইংরেজিতে যাদের নাম prudence, Fortitude, Justice আর Temperance। ফোয়ারার সামনে দুদিকে দুটো ড্রাগন, যাদের মুখ দিয়েও জলের ফোয়ারা।


A fountain in Paris
Fontaine Saint-Michel

দ্রষ্টব্য এক - বন্ধ নত্রে দামে ক্যাথেড্রাল


ব্রিজটা পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তাটা ধরে ১০ মিনিট মতো একটু হাঁটা হাঁটি করলাম। নদীর ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপটে দাঁড়ানো যায় না, তাও অনেক লোক এই রাতেও নদীর পাড়ের বাঁধানো রাস্তায় হাঁটছে, গল্প করছে, ছবি তুলছে। নদীতে ছোট সুদৃশ্য নৌকাও চলতে দেখলাম, যেরকম দেখেছি গুয়াংজুর পার্ল নদীতে। নদীর উলটো দিকে, মানে যেদিক থেকে আমি এলাম, কিছু সুভেনিরের দোকান তখনও খোলা। আমার বাঁদিকে পড়লো একটা অট্টালিকা – ম্যাপে দেখলাম সেটা প্যারিস পুলিশের কার্যালয়, নাম Prefecture de Police de Paris। আর আমার সামনে, অন্ধকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নত্রে দামে ক্যাথেড্রাল। আসার আগেই জেনেছিলাম, ক্যাথেড্রাল বন্ধ, কাজ চলছে। ২০১৯ এর ১৫ই এপ্রিল এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই স্থাপত্য, তার পর থেকেই অনুগামী ও দর্শকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় ক্যাথেড্রালের দরজা। আমি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম সেখানে, শহরের কোলাহলের মধ্যে দাঁড়িয়েও অনুভব করা যায় যেন চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে কত ইতিহাসের সাক্ষ্যে, কান পাতলে এখনও যেন শোনা যায় তার দীর্ঘশ্বাস। গা নিজের অজান্তেই ছমছম করে ওঠে। রাত বাড়ছে, হোটেলে ফিরতে হবে, শরীরটাও আর চলছে না। ফিরলাম উলটো মুখে। পেছনে ফেলে আসা পথে দাঁড়িয়ে থাকল নত্রে দামে, অপেক্ষায় কবে ফিরবে সে তার পুরনো গরিমায়।


A church in Paris
Notre Dame Cathedral

নত্রে দামে থেকে হোটেলে ফিরতে সময় লাগলো ১০ মিনিট মতো। এখান থেকে নিয়ে যাওয়া ব্রেড আর কফি দিয়ে ডিনার সেরে সোজা লেপের তলায়। আসার আগে জেনে এসেছি, কাল সকাল ৭টা থেকে ব্রেকফাস্ট শুরু, চলবে ১০টা অবধি। রুমটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, খাটে শুয়ে কালকের প্ল্যানটা ভালো করে ঝালিয়ে নিলাম মোবাইলের ম্যাপে। কাল ঠিক করেছি সাড়ে ৭ টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ব। কাল উঠতে পারবে তো সময়ে? জানি না, মোবাইলের অ্যালার্মই ভরসা। এখন বেঝেছে সাড়ে ১০টা। আজকের তোলা ছবি গুলো দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম সেটা বুঝতেই পারলাম না।

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page